চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবেন মেরিনা, তার সঙ্গে ‘যা খুশি’ করতে পারেন

মেরিনা আব্রামোভিচ। সার্বিয়ার এক জন ‘পারফরম্যান্স’ শিল্পী। তার বর্তমান বয়স ৭৫ বছর। তার জন্ম সার্বিয়ার বেলগ্রাদে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে দর্শকদের সঙ্গে জীবনদর্শনের কথা বলাই ছিল তার শিল্প।

পাশাপাশি দর্শকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মনস্তত্ত্ব বোঝার চেষ্টাও করতেন মেরিনা। আস্তে আস্তে দেশেবিদেশে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। তবে ১৯৭৪ সালে তার নেয়া এক সিদ্ধান্ত তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিল। যে সিদ্ধান্তের জন্য মেরিনার মৃত্যু হতে পারত তার কথা শুনতে আসা দর্শকদের হাতেই।

দর্শকদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে ১৯৭৩ সাল থেকে ‘রিদম’ নামে একটি শোয়ের আয়োজন করেন মেরিনা। দুই বছরে মেরিনা ‘রিদমে’র মোট পাঁচটি শো করেন। তবে শেষ শোয়ে তার জীবনে মহাসঙ্কট নেমে এসেছিল।‘রিদম’ সিরিজের ঐ শো ১৯৭৪ সালে ইতালির নেপলসে্‌র একটি প্রেক্ষাগৃহে মঞ্চস্থ হয়। শোয়ের নাম ছিল ‘রিদম ০’। ছয় ঘণ্টার ঐ শোয়ের শুরুতে মেরিনা মঞ্চের উপর একটি টেবিল এনে রাখেন। এরপর একে একে সেই টেবিলের উপর রাখেন ৭২টি বস্তু।

ঐ ৭২টি বস্তুর মধ্যে গোলাপ, পালক, সুগন্ধি, মধু থেকে শুরু করে খাবার, মদ, কাঁচি, পেরেক সবই ছিল। রাখা হয়েছিল একটি বন্দুক এবং কার্তুজও। দর্শকাসনে বসে থাকা জনগণকে মেরিনা নির্দেশ দেন, আগামী ছয় ঘণ্টা তিনি মঞ্চে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবেন। ঐ ছয় ঘণ্টা তার সঙ্গে ‘যা খুশি’ করতে পারেন দর্শকেরা। তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া জানাবেন না।

দর্শকদের উদ্দেশে মেরিনা বলেন,‘টেবিলে ৭২টি জিনিস আছে। সেগুলো আপনারা আমার উপর ইচ্ছা মতো ব্যবহার করতে পারেন। আগামী ছয় ঘণ্টা আমাকেও যেন বস্তু হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। এই সময়ের মধ্যে আমার কিছু হলে তার দায় আমার।’ সেই ‘যা খুশি’র মাপকাঠি বেঁধে দেননি মেরিনা। সেটাই ছিল তার জীবনের সব থেকে বড় ভুল।

শোয়ের শুরুটা ভালোই হয়েছিল। দর্শকদের কেউ কেউ গোলাপ, সুগন্ধি নিয়ে মেরিনার দিকে এগিয়ে যান। কেউ কেউ আবার মেরিনার হাতে-গালে আলতো চুম্বনও করেন। তবে এক ঘণ্টা পেরোতেই অস্থির হয়ে ওঠেন উপস্থিত দর্শকের একাংশ। অনেকে এসে তার হাত ধরে টানাটানি করতে শুরু করেন। অনেকে আবার মেরিনার হাত ধরে তাকে শূন্যে ছুড়ে দিচ্ছিলেন।

অনেকে মেরিনাকে অন্তরঙ্গ ভাবে স্পর্শ করতেও শুরু করেন। তবে এতো কিছুর মধ্যেও মেরিনা কিন্তু চুপ করেই ছিলেন। মেরিনাকে দেখে অনেকের মনে হয়েছিল তিনি যেন এক জীবন্ত মূর্তি। এরপর দর্শকদের কাণ্ডকারখানায় নেপলসে্‌র ঐ প্রেক্ষাগৃহের মঞ্চ আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তিন ঘণ্টা পর কিছু দর্শক কাঁচি-ব্লেড নিয়ে মেরিনার জামাকাপড় ফালা ফালা করে দেন। টান মেরে খুলে দেন হয় ছিন্নবিচ্ছিন্ন পোশাক। তবে এরপরও মেরিনার অভিব্যক্তিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

মেরিনার চোখেমুখে ভয় দেখতে পেয়ে যেন আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন উন্মত্ত দর্শকেরা। শোয়ের চার ঘণ্টা পেরোনর পর অনেকে মেরিনার নিরাবরণ দেহে ব্লেড চালাতে শুরু করেন। মেরিনার গলার কাছে ব্লেড চালিয়ে দিয়েছিলেন এক দর্শক। সেই কাটা জায়গা থেকে রক্ত বেরোতে শুরু করলে ঐ দর্শক সেই রক্ত পান করতে শুরু করেন! কিছু ক্ষণের মধ্যেই শুরু হয় অবাধ যৌন নির্যাতন। এরপরও টুঁ শব্দ করেননি মেরিনা। চোখ থেকে পানি বেরিয়ে এলেও মুখে কোনো কথা বলেননি। মেরিনাকে দেখে অনেকের এ-ও মনে হয়েছিল, সেই রাতে তাকে খুন করলেও তার তরফে কোনো প্রতিক্রিয়া আসবে না।

শেষমেশ আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে উপস্থিত দর্শকদের একাংশ। ছয় ঘণ্টা শেষের কিছু আগে এক দর্শক হাতে তুলে নেন টেবিলের উপরে থাকা বন্দুক। গুলি ভরে বন্দুকের নল ঠেকান মেরিনার মাথায়। উল্লাস শুরু করেন অন্য দর্শকেরা। এরপরেও মেরিনা নীরব থাকায় ঐ দর্শক মেরিনার আঙুল নিয়ে বন্দুকের ট্রিগারে রাখেন। মেরিনার আঙুল এবং বন্দুক নিয়ে ‘খেলা’ করতে থাকেন। বার বার ট্রিগারে চাপ দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হয় মেরিনাকে। চোখ থেকে দরদর করে পানি ঝরলেও মেরিনার অভিব্যক্তিতে কিন্তু কোনো পরিবর্তন আসেনি।

তত ক্ষণ পর্যন্ত চুপ করেই ছিলেন শোয়ের আয়োজকরা। কিন্তু দর্শকদের কাণ্ডকারখানা দেখে তাদের মনে ভয় ধরতে শুরু করে। যে কোনো মুহূর্তে অঘটন ঘটে যেতে পারে ভেবে দর্শকদের থামাতে উদ্যত হন তারা। প্রথম থেকে শান্ত থাকা কয়েক জন দর্শকও সরব হয়ে ওঠেন। ধাক্কা মেরে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় বেপরোয়া দর্শকদের। হাতের সামনে থেকে সরিয়ে ফেলা হয় ব্লেড-কাঁচি-বন্দুক। ঐ শোয়ে হাজির ছিলেন শিল্প সমালোচক টমাস ম্যাকেভিলি। মেরিনার প্রতি দর্শকদের ব্যবহার দেখে তিনি চমকে যান বলেও পরে এক সাক্ষাৎকারে টমাস জানিয়েছিলেন।

সেই ঘটনা সম্পর্কে মেরিনা পরে বলেন, ‘ঐ শোয়ের পর আমি শিখেছিলাম যে, নিজেকে দর্শকদের হাতে সঁপে দিলে তারা আপনাকে খুনও করতে পারে!’ শো শেষে তিনি যখন কথা বলতে শুরু করেন, তখন তার উপর অবাধে অত্যাচার চালানো জনতা দর্শকাসন ছেড়ে বেরিয়ে যায় বলে মেরিনা এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছিলেন।